নলিনীর সংসার
– অঞ্জনা গোড়িয়া
নলিনী এখন বৃদ্ধাশ্রমে বারো নম্বর সদস্যা। বয়স পঞ্চান্ন কি ষাট। এখনো বেশ শক্তপক্ত মহিলা। ভরা সংসার ছেড়ে স্বেচ্ছায় বিদায় নিয়েছে। ভাবে নি কোন দিন এভাবে একা হয়ে যাবে।
এখানে অবশ্য বেশ ভালো আছে। নিজে হাতে বাড়ির মতোই সমস্ত কাজ করে। নলিনীকে তাই আশ্রমের সবাই খুব আপন করে নিয়েছে। ভালোবাসায় ভরিয়ে তুলেছে। একটা পুরানো ডায়েরি আর ফোটো ফ্রেম সব সময় মাথার পাশে থাকে। গভীর রাতে পাতা উল্টে দেখে সেই ছবিগুলি। যেখানে আদর মাখানো বাবার স্নেহ লেগে আছে। মায়ের কোলে ছোট্ট নলিনীর ছবি। আর নিজের সংসারের ছেলে মেয়ে স্বামীর সঙ্গে তোলা ছবি। চোখের সামনে ভেসে আসে সেই দিনগুলি। ডায়েরীটা খুলে চোখ বুলিয়ে নেয় প্রতি দিন। অনেক বছর আগের ডায়েরি। এখন আর তেমন লেখা হয় না। যেদিন প্রথম বাড়ি ছেড়ে বৃদ্ধাশ্রমে আসে, সেই শেষ লেখা ডায়েরীটা। পড়তে পড়তে মনের দরজায় ধাক্কা দিল পুরানো কিছু স্মৃতি।
বই পড়তে বসে রোজই নলিনী ঘুমিয়ে পড়তো। মা চুলের মুঠি ধরে টেনে তুলতো। কাঁদো কাঁদো হয়ে একদিন বলেই ফেলল,’আর পড়ব না মা। ভাল্ লাগে না পড়তে। বিয়ে করব। তা হলে আর পড়তে হবে না। বলো মা?’
মা মেয়ের কথায় মুচকি হেসে বলল, ‘বোকা মেয়ে আমার। বিয়ে হলে বুঝি পড়তে হয় না? তুই এখন বুঝবি মা, কত জ্বালা বিয়ে হলে।’
কোনো ক্রমে গড়িয়ে গড়িয়ে মাধ্যমিকটা পাস করল। নলিনীর মনটা কিন্তু খুব সরল। কেউ কোনো বিপদে পড়লে ছুটে আসত। কেউ টিফিন আনে নি শুনলেই নিজের টিফিনটা বাড়িয়ে দিত। হাসিখুশিতে মজা করে সারা ক্লাস মাতিয়ে রাখত।
পড়াশোনা করতেই শুধু ভালো লাগত না।
মাঠে গরু চড়াতে, গিনিপিগ এর জন্য ঘাস কাটতে খুব ভালোবাসে। আর ভালোবাসে বাবার সাইকেলে বসে ঘুরে বেড়াতে। বাবা অফিস থেকে ফিরলেই আবদার করত,চলো না বাবা মাঠের ধানজমিটা দেখি আসি। কেমন হেলে দুলে মাথা নাড়ছে। সবুজ মাঠ ঘাট আর বয়ে যাওয়া খালের জলের ঢেউ দেখা ছিল খুব পছন্দের।মাঠের রাস্তা ধরে একবার ঘুরিয়ে আনতেই হত।নলিনীর দিদি কমলিনী খুব লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে।কাজ -কর্মে সিদ্ধহস্ত।
এক দিন স্কুল থেকে ফিরেই দেখে একদল মানুষ দেখতে এসেছে দিদিকে। মাকে জিজ্ঞেস করল, ‘এমন করে দেখছে কেন দিদিকে? দিদি কি জিনিস? বিক্রি করছ?’
সবাই হাঁ করে তাকিয়ে রইল নলিনীর কথায়।
মা বুঝিয়ে বলল, ‘দিদির যে বিয়ে হবে সোনা।’
নলিনী কি বুঝল, কে জানে। মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল। দিদির বিয়ে হল বেশ ধুমধামে। নলিনী একা হয়ে গেল। ছোট্ট নলিনী কেমন বড় হয়ে গেল।
কিছুদিন পরই দিদি বাপের বাড়ি ফিরল। মুখটা কেমন থমথমে। বারবার নলিনী জানতে চায়লো, ‘কি হয়েছে তোর? কিছু বলল না। মায়ের কাছে কি সব বলছে আর চোখ দু’টি জলে টসটস করছে। চলে গেল দিদি কাঁদতে কাঁদতে। মাকে জানতে চাইল, দিদি কাঁদছে কেন মা?’ মা বুঝিয়ে বলল, ‘ও তুই বুঝবি না। পরের বাড়ি চলে গেলে এমন কান্না পায়।’
দিদি কমই আসতো। আমাকে ও তেমন যেতে দিত না। একদিন নলিনী বাবা মায়ের কথা শুনতে পায়। শ্বশুরবাড়িতে ঠিক মত খেতে দেয় না। সমস্ত কাজ একা হাতে সামলাতে হয়। তার ওপর শ্বশুরের কুদৃষ্টি পড়েছে দিদির ওপর। তবু অসহায় হয়ে পড়ে থাকতে হবে ওখানে। আড়াল থেকে সব কথা শুনে রাগে নলিলী বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। মায়ের কাছে ছুটে গেল। ‘ফিরিয়ে আনো মা, দিদিকে। থাকতে হবে না অমন বাড়িতে।’ মা বুঝিয়ে বলে, ‘মেয়েদের সব কিছু সহ্য করতে হয়। কাউকে বলিস না মা এ সব কথা। এটাই ওর ভাগ্য।’
ভাগ্যের দোহাই দিয়ে বছর ঘুরে গেল।
কিছু দিন পর শুনল, নলিলী মাসি হবে। কি আনন্দে মনটা নেচে উঠল।
ফুট ফুটে একটা মেয়ে হল, দিদি বাপের বাড়ি চলে এল। একমাস যায় দু’মাস যায়, কেউ আর বাড়ি ফিরিয়ে নিতে এল না।
জামাই বাবু আসে বটে, বাড়িতে লুকিয়ে।
বাবার কড়া নির্দেশ,বাড়িতে মেয়ে নিয়ে ঢুকতে পারবে না। বংশের বাতি না এলে আবার বিয়ে দেবে ছেলের।
জামাইবাবুর বাবার মুখের ওপর কিছু বলার সাহস ছিল না। আবার বছর ঘুরতে না ঘুরতে পোয়াতি হল কমলিনী।
একে কম বয়স। তার ওপর বছর ঘুরতে না ঘুরতে দু’- দু’টো বাচ্ছা। ডাক্তার বললো, ‘সাবধানে থাকতে হবে’ শ্বশুর মশাই বাড়ি নিয়ে গেল। ছেলে হবে শুনে। কিন্তু বাড়ি গিয়ে সেই কাজ আর কাজ। শরীরটা আরো খারাপ হয়ে গেল। হসপিটালে ভর্তি করতে হল। সময়ের আগেই।
ডাক্তার বলল, ‘যে কোনো একজন কে বাঁচানো যাবে। নলিলীর বাবা মা বার বার অনুরোধ করল, ‘মেয়েকে বাঁচিয়ে দিতে।’
শুনল না শ্বশুর মশাই। ডাক্তারকে জানিয়ে দিলেন, ‘আমার নাতি চাই। ছেলে হলে, নাতিকেই বাঁচাতে হবে।’
অসহায় মেয়ের বাবা মা ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করতে লাগল।
কান্নার আওয়াজ ভেসে এল। ছুটে গেল সবাই। শ্বশুরের জিজ্ঞাসা, ‘নাতি না নাতনি?’ মায়ের আর্তি, মেয়ের প্রাণ। ঈশ্বরের কৃপায় দু’জনেই ভালো আছে।
নার্স বাইরে এসে জানালো, ‘মিষ্টি মুখ করান। নাতি হয়েছে আপনাদের দু’জনেই ভালো আছে।’ দুই বাড়িতে আনন্দ উৎসবে মেতে উঠল।দিদি মহা আনন্দে ধুমধাম করে বাড়ি গেল।দিব্যি ছিল দুই ছেলে মেয়েকে নিয়ে।
এ দিকে নলিনীও বেশ সুন্দরী হয়ে উঠেছে। বিএ পাস করল, কোনোক্রমে।
ঠিক সেই সময় দিদি এসে হাজির। সারা শরীরে কালসিটে দাগ। চোখের কোনে কালি। মাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিল, ‘হয় এ বাড়িতে রাখো, নয় তো আর কোন দিন ও ফিরব না ওই বাড়ি।’ অসহ্য যন্ত্রনায় মায়ের কানে কি সব বলল মা বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিল। বলল, ‘তোর বাবা ফিরলেই আমরা যাব। এবার কিছু একটা ব্যবস্থা করেই ফিরব। চিন্তা করিস নি মা।’
বাবা ফিরতে, সব কিছু জানাল, আর চেপে থাকা যায় না। নলিনী যেতে চাইল সংগে।
বারন করল মা, সবে মাত্র বাড়ি থেকে এক পা দিয়েছে। থানা থেকে পুলিশ এসে হাজির। দুসংবাদ দিতে।
আজ রাতেই আপনাদের মেয়ে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। হসপিটালে ভর্তি করেছিল, সেখানেই মারা গিয়েছে।এখুনি একবার থানায় যেতে হবে, আপনাদের। বয়ান দিতে।
মেয়ের জন্য কিছু তিলের নাড়ু বানিয়ে ছিল। খেতে খুব ভালোবাসত। ছিটকে পড়ল কোটোটা।
কান্নায় ভেঙে পড়ল। বাবা পাগলের মত হয়ে গেল। দু’দুটো ছেলে মেয়েকে কে দেখবে? শ্বশুর মশাই এর অপরাধে জামাই শান্তি পাবে।
থানায় কেস করলে, জামাই এর বদনাম। বাচ্ছা দু’টি আরো অসহায় হয়ে পড়বে। ভেবে ছিল ওদের বাড়ি নিয়ে আসবে। নলিণীদের আর্থিক অবস্থাও তেমন ভালো নয়। কোনোক্রমে চলে। কি করে মানুষ করবে এদের?
সব কিছু ভেবে চিনতে, মিটিয়ে নিল নিজেরা। মেয়ের দাহ হয়ে গেল। নলিনী ক্ষেপে উঠল। কিছুতেই দিদির এমন মৃত্যু মেনে নেবে না।
শ্বশুরের অপরাধের শাস্তি পেতেই হবে।
বাবা মায়ের কথা ভেবে, আর বাচ্ছা দু’টোর দেখাশোনা করার জন্য নলিলী নিজেই রাজী হল জামাইবাবুকে বিয়ে করতে।
অবাক হয়ে গেল বাবা। অনুষ্ঠান না করেই কোনোক্রমে বিয়ে হল।
প্রতিশোধের আগুন মাথায়। এ দিকে দিদির দু’টো ছেলে মেয়ের দায়িত্ব কাঁধে।
শ্বশুর মশাইকে চা জলখাবার দিতে গেল। শ্বশুরের লকলকে জিভটা টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে হল। নলিলী জানে, এখন এ বাড়ির বউ। উনি সম্মানিত ব্যক্তি, গুরুজন। ছোট বেলায় শিখেছে, গুরুজনদের শ্রদ্ধা করতে হয়। এমন গুরুজন, যার চিন্তায়, দুষ্টু বুদ্ধিতে কারোর জীবন চলে যেতে পারে।
হাতে মোবাইলটা অন করাই ছিল।
শ্বশুরের ঘরে গেল। ইচ্ছে করেই শুয়ে ছিল। নলিনী চায়ের প্লেটটা দেখিয়ে বলে,’বাবা,আপনার চা। উঠে আসুন।’
বলল, ‘মাথাটা ধরেছে বউমা। একটু টিপে দিতে পারো?’
নলিলী এই সুযোগটাই খুঁজছিল। ভিডিও রেকোর্ডিংটা অন করে রাখে। কাছে যেতেই হাত দু’টি জোর করে টেনে নেয় বুকে।
‘এসব কি করছেন বাবা? আপনি না বয়োজ্যেষ্ঠ।আমি আপনার মেয়ের মত ছাড়ুন’ জোর করে জাপ্টে ধরতে চায়। সেই সময়ই চিৎকার করে ওঠে। বাঁচাও বলে। শ্বশুর মশাই ভয় পেয়ে যায়।
‘আরে চেঁচিয়ে ও না। অনেক টাকা দেব। তোমার দিদি তো এমন করত না। চুপচাপ সহ্য করত। আমি না তোমার শ্বশুর, সবাই এসে পড়বে।’
নলিলী বলল, ‘আমি দিদি নই। আপনার কারণইে মরতে হয়েছে আমার দিদিটাকে। এবার আপনার পালা। সব রেকর্ড করে নিয়েছি।’
ভয় পেয়ে যায় বৃদ্ধ শ্বশুর মশাই। ‘ভুল হয়ে গেছে বউমা। কি চাও বলো, সব দেবো। আর লোক জানিও না।’
নলিনী, ভাবল, দিদি তো আর ফিরবে না। যা শান্তি পাওয়ার ঈশ্বরই দেবেন।
একটাই শর্ত, ‘কারখানাটা ছেলের নামে লিখে দিন। আর নাত নাতনির নামে বিষয় সব লিখে দিন। যাতে আর ক্ষমতা জাহির করতে না পারেন। আর কোনো দিন কাউকে এমন করবেন না। মেয়েদের সম্মান দিতে শিখুন।’ সব শর্তে রাজি হল।
বেশ কয়েক বছর পর শয্যাশায়ী হয়ে মারা গেলেন।
এ দিকে নলিনী দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে দিব্যি সংসার করছিল। এদের ভালো রাখতে নিজের সন্তান জন্ম দিল না। এরাই সব। ছেলে মেয়েরা ও বেশ বড় হয়েছে। দীর্ঘ ২৫ বছর সংসার সামলে নলিনী বেশ গিন্নী হয়ে উঠেছে। এবার মেয়ের জন্য পাত্রের খোঁজ শুরু হলো।
হঠাৎ এক জলঝড়ের রাতে স্বামীর আসতে দেরী হল।
ফোন করে ও কোন উত্তর পেল না।
কিছুক্ষন পর খবর এল, রাস্তায় পড়ে থাকা কাটা তারে, পা লেগে ইলেকট্রিক শক খেয়েছে। হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার আর সুযোগ হল না।
শেষ হয়ে গেল স্বামী।
কারখানার কাজ নিজের কাঁধে এসে পড়ল।
কোনক্রমে বিয়ে দিল মেয়েটার।
নিজের ছেলেটা , দুষ্টু ছেলেদের পাল্লায় পড়ে নেশা করতে শিখেছে। উল্টো পালটা গালি-গালাজ দিতে শুরু করল মাকে। তবু মেনে নিয়েছিল ছেলেকে। যেদিন কারখানার সমস্ত শ্রমিকদের মাইনের টাকা চুরি করে পালাল, আর মানতে পারল না।
পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিতে বাধ্য হল।
কারখানাটা বন্ধ হয়ে গেল দেনার দায়ে। বিক্রি করে দেনা শোধ করতে বাধ্য হলো। ছেলেকে অবশ্য পরে ছাড়িয়ে আনল।
কিন্তু সে আরো রেগে আগুন হল। সৎমা বলে, উল্টো পালটা কথা বলতে লাগল।
এই নলিনী একদিন এদের কথা ভেবে স্বেচ্ছায় জামাইবাবুকে বিয়ে করেছিল।
নিজের সন্তান স্নেহে বড় করেছে। নিজে না সন্তান জন্ম দিয়ে।
আজ এই পরিনতি।
এক দিন সকালে কেউ আর নলিনীর খোঁজ পেল না। যা কিছু গহনা টাকা পয়সা ছেলের নামে লিখে একটি চিরকুটে রেখে চলে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও কেউ আর খোঁজ পেল না। ছেলে বুঝতে পারে কত বড় অপরাধ করেছে।
এখন বাড়িটা শ্বশান পুরী হয়ে গেছে।
ছেলেও কোথায় যেন চলে গেছে।
সেই নলিলীই বৃদ্ধাশ্রমের একজন। মায়ার জাল থেকে বেড়িয়ে আজ মুক্ত।
সবাই কে ভালো বেসে। সংসার পেতেছে নতুন করে এই আশ্রমে। তবু কেন যে চোখ টা ঝাপসা হয়ে আসে মাঝেমধ্যে কে জানে??